কুষ্টিয়ার তিলের খাজার নাম শোনেনি বা খায়নি এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া মুশকিল। হাতে তৈরি খেতে দারুণ সু-স্বাদু কুষ্টিয়ার তিলের খাজা দেড়শ’ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই খাবারটি কুষ্টিয়ার নামের সাথেই মিশে আছে। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে নানা রকম হাক ডাকের মাধ্যমে রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টেশন ও লঞ্চ ঘাটসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হতে দেখা যায় কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অনটন আর পৃষ্ঠপোশকতার অভাবে হারিয়ে যাবার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে এই শিল্প। এরপর আবার নতুন করে মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রভাব। সব মিলিয়ে চরম মানবেতর জীবন-যাপন করছে এই পেশার মানুষ।
‘হায় রে মজার তিলের খাজা খেয়ে দেখলি না মন কেমন মজা; লালন কয়, বেজাতের রাজা হয়ে রইলাম এ ভুবনে..। অনেকেই বলেন, লালন ফকির দেড়শ’ বছর আগে তিলের খাজা নিয়ে এমন কথা বলেছিলেন। এটা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও জনশ্র“তি থেকেই তিলের খাজা নিয়ে এমন গান চলে আসছে।
ইতিহাস বলে, অখন্ড ভারতীয় উপমহাদেশের সময়কালেই তিলের খাজার প্রচলন ঘটে কুষ্টিয়ায়। ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হওয়ার আগে শহরের মিলপাড়ায় ও দেশওয়ালী পাড়ার পাল সমপ্রদায়ের বেশ কয়েকটি পরিবার তিলের খাজা তৈরী শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে ছেঁউড়িয়ার আবদুল মজিদ, চাঁদ আলী, সাইদুল ইসলাম, ইদিয়ামিন, সরওয়ারসহ আরও কয়েকজন মিলে কারখানায় তিলের খাজা তৈরির ব্যবসা করে এই শিল্পের দেড়শ’ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
এখন মিলপাড়াতে বিখ্যাত ‘ভাই ভাই তিলের খাজা’ নামের একটিই মাত্র কারখানা রয়েছে। এ কারখানার বয়স আনুমানিক ৪৬ বছর। দেশে চলমান মহামারি করোনা ভাইরাসের কারনে কারখানাটি ৫মাস বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবন-যাপন করেছে এই কারখানার মালিকসহ কর্মরত ৩৫ জন শ্রমিক। সরকারী-বেসরকারী কোন সহযোগীতাও পাইনি তারা। দীর্ঘ ৫মাস বন্ধ থাকার পর গত সপ্তাহে সীমিত আকারে কারখানাটি চালু হওয়ায় কিছুটা স্বস্তিত্বে এখানকার শ্রমিকরা। সব মৌসুমেই রাতে তৈরী হয় তিলের খাজা, দিনে বিক্রি হয়। চিনি ও দুধ জ¦ালিয়ে নির্দিষ্ট ঘনত্ব আসার পর হালকা ঠান্ডায় জমাটবেধে চিনির সিরা বা একটা মন্ডা তৈরী হয়। সেই মন্ডা দ্বোচালা গাছের সাথে হাতে টানা হয়। হালকা বাদামী থেকে সাদা রঙে পরিণত হলেই কারিগর তার নিপুন হাতের ভাজের টানে ভেতরের অংশটা ফাঁপা করে। পরে বিছিয়ে রেখে তা নির্দিষ্ট মাপে কাটা হয়। ওই কাটা অংশের উপরে মেশানো হয় খোসা ছাড়ানো তিল। এরপর প্যাকেটজাত।
এভাবেই তৈরী হয় তিলের খাজাঁ। দেশে করোনা ভাইনাসের প্রভাব শুরুর আগে এই কারখানায় প্রতিরাতে প্রায় আড়াইশ’ কেজি তিলের খাজা তৈরী হত। যা দিনে জেলা ছাড়িয়ে বাইরেও বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। তবে স্বাধীনতার পর দেশের অনেক কিছু বদলালেও ভাগ্য বদলায়নি এ শিল্পের সাথে জড়িতদের। চিনি ও তিলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় লোকশানের আশংকায় অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন এই শিল্প। বহু পুরোনো মজাদার সুস্বাধু এই তিলের খাজা এখনও ছোটবড় বৃদ্ধ সবার মন কাড়ে। তিলের খাজা ১০০টাকা কেজি ও এক প্যাকেট ১০ টাকায় বিক্রি হয়। দামে কম বলে এটি গ্রামে-গঞ্জেও খুব জনপ্রিয়। এটা বিক্রি করে বহু হকার জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা বলছেন করোনা ভাইরাসের কারনে কারখানা ৫মাস বন্ধের পর আবার চালু হলেও তিলের খাজা বিক্রি অনেক কমে গেছে। কুষ্টিয়া ছাড়াও ঢাকা ও দেশের কয়েকটি জেলায় তিলের খাজা তৈরীর কারখানা আছে। তবে অন্য জেলায় তৈরী হলেও অনেকেই এটি কুষ্টিয়ার নাম দিয়ে বাজারে ছাড়েন। কুষ্টিয়ার ব্রান্ডিং এই শিল্পটিকে বাচিঁয়ে রাখতে সহযোগীতার কথা বললেন জেলা প্রশাসক। কুষ্টিয়ার তিলের খাজা শিল্পকে বাচিঁয়ে রাখতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এমনটাই দাবী সংশ্লিষ্টদের।