সৌদি আরবে এক বাংলাদেশি গৃহকর্মীকে হত্যাকাে র ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় গৃহকর্ত্রীকে মৃত্যুদ এবং গৃহকর্তাকে কারাদ ও জরিমানা করেছে দেশটির অপরাধ আদালত। এ রায়ে সন্তুষ্টি জানিয়েছে নিহতের পরিবার। মামলার রায়ে যে শাস্তি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া গৃহকর্মী আবিরন বেগমকে হত্যার মামলায় মোট তিনজনকে আসামী করা হয়েছে। তারা হলেন গৃহকর্ত্রী, গৃহকর্তা এবং তাদের কিশোর বয়সী ছেলে। মামলার প্রধান আসামী গৃহকর্ত্রী আয়েশা আল জিজানীর বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত এবং সুনির্দিষ্টভাবে হত্যাকা সংঘটনের দায়ে আদালত কেসাস বা ‘জানের বদলে জানের’ রায় প্রদান করে। আদালত এ রায় ঘোষণা করে ১৪ই ফেব্রুয়ারি। ওই মামলায় গৃহকর্তা বাসেম সালেমের বিরুদ্ধে হত্যাকাে র আলামত ধ্বংস, আবিরন বেগমকে নিজ বাসার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় কাজে পাঠানো ও চিকিৎসার ব্যবস্থা না করার অভিযোগে মোট ৩ বছর ২ মাসের কারাদ াদেশ দেয়া হয়। সেইসঙ্গে তাকে ৫০ হাজার সৌদি রিয়াল জরিমানা দিতে বলা হয়েছে। মামলার তৃতীয় আসামী সৌদি দম্পতির ছেলের বিরুদ্ধে হত্যাকাে সংশ্লিষ্ট থাকার কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে আবিরন বেগমকে বিভিন্নভাবে অসহযোগিতা করায় তাকে সাত মাস কিশোর সংশোধনাগারে থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও সৌদি আরবের রিয়াদের শ্রম কল্যাণ উইং এর এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। সৌদি আরবে কোন বাংলাদেশি হত্যার ঘটনায় এই প্রথম কারো মৃত্যুদ হলো। তবে আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার সুযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। যেভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আবিরন বেগম খুলনার পাইকগাছার বাসিন্দা আবিরন বেগম স্থানীয় এক দালালের সাহায্যে ঢাকার একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ২০১৭ সালে সৌদি আরবে যান গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে। এরপর ২০১৯ সালের ২৪শে মার্চ রিয়াদের আজিজিয়ায় তিনি নিহত হন। তার মরদেহের ফরেনসিক প্রতিবেদনে হত্যাকাে র বিষয়টি সামনে আসে। তারপরই দেশটির পুলিশ তদন্ত শুরু করে। তবে আবিরনের মরদেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দিলে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সহায়তার হত্যাকাে র ৭ মাস পর ওই বছরের ১৪ই অক্টোবর তার মরদেহ দেশে ফেরানো হয়। মরদেহের সঙ্গে আসা আবিরনের মৃত্যু সনদে মৃত্যুর কারণ “হত্যা” কথাটি লেখা ছিল। আবিরন বেগমের পরিবারের অভিযোগ যে, সেখানে কাজ করতে যাওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় তাকে নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। তার ভগ্নিপতি আইয়ুব আলীর জানিয়েছেন যে তার মাথা দেয়ালে ঠুকে মারা হয়েছে, বেঁধে পেটানো হয়েছে, গিজারের গরম পানি ঢেলে শরীর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এছাড়া তাকে সারাদিন অমানসিক পরিশ্রম করানো হলেও পর্যাপ্ত খেতে দেয়া হতো না। এছাড়া তার ওপর যৌন নিপীড়ন হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। আবিরন বেগমের নিজের কোন ফোন ছিল না। এজেন্সির লোকজনের সাহায্যে বা বাড়ির মালিকের হাতে পায়ে ধরে মাসে হয়তো ১/২ বারের জন্য তিনি কথা বলতে পারতেন। এরপরে দীর্ঘ সময় পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। পরে পরিবার আবিরন বেগমেরর মৃত্যুর খবর পান। আইয়ুব আলী বলেছেন যে, আবিরন বেগমের বয়স চল্লিশের বেশি ছিল, কিন্তু তার লাশ যখন তারা বুঝে পান তখন তার ওজন ছিল মাত্র ৩১ কেজি। এবং শরীরের সর্বত্র অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। এছাড়া আবিরন বেগম সেখানে দুই বছরের মতো কাজ করলেও আজও তার পরিবার পারিশ্রমিক বুঝে পাননি। পরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিহতের পরিবার, নিয়োগকারী সংস্থা, মন্ত্রণালয়, দূতাবাস সব জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে ডিসেম্বরে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সৌদি আরবে যাওয়ার পর থেকেই মধ্যবয়সী আবিরনকে পিটিয়ে, গরম পানিতে ঝলসে এবং আরও নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। সাত মাস সেখানকার এক মর্গে আবিরনের লাশ পড়ে ছিল। প্রতিবেদনে রিয়াদ দূতাবাসের মাধ্যমে আবিরনের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়, অভিযুক্ত নির্যাতনকারীদের আদালতের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং এদেশের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করা হয়। সৌদির রায়ে সন্তুষ্টি, দেশে বিচার শুরুর দাবি নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় আবিরন হত্যাকাে র বিচারকাজ। এর ১৬ মাসের মধ্যেই গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি, রায় ঘোষণা হল। এই রায়ে নিহতের পরিবার তাদের সন্তুষ্টি জানিয়েছেন, তারা বলছেন যে এখন তাদের হারানোর কিছু নেই। এখন এই বিচার হওয়ায় তারা অন্তত এতোটুকু স্বস্তি পাবেন যে এ ধরণের ঘটনায় একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন হল যে, শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে কেউ যদি নির্যাতনের শিকার হয় তারও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। সৌদি আরবে কোন বাংলাদেশি হত্যার ঘটনায় বিচার হওয়াটাই বিরল ঘটনা, আর এক্ষেত্রে রায় ঘোষণা বলতে গেলে এবারই প্রথম। তার ওপর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ দেয়া হয়েছে। জেল জরিমানা হয়েছে। এ কারণে পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারা সবাই আসলে রায়ে সন্তুষ্টি জানিয়েছেন। আবিরনের মৃত্যুতে সৌদি আরবের আদালতও দুঃখ প্রকাশ করেছে। গত ৬ই জানুয়ারি এই মামলার সবশেষ শুনানি ছিল। এ সময় আদালত নিহতের পরিবারের দাবি জানতে চাইলে দূতাবাস প্রতিনিধিরা জানিয়েছিলেন যে তারা কেসাস চান। আসামীপক্ষের আইনজীবী গৃহকর্তা বাসেম সালেমির জামিনের আবেদন করলেও আদালত তা নাকচ করে দেয়। তবে নিহতের পরিবারের এখন দাবি যে সৌদি সরকার তো নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। এখন তারা দেশের যে দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সি এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারি রয়েছেন যারা পরোক্ষভাবে হলেও এ ঘটনার সাথে জড়িত তাদের বিচার দাবি করেছেন, দেশের আদালতে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনেও এদেশের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। নারী শ্রম বাজারে ঝুঁকি কমানোর উপায় আছে? দীর্ঘ সময় সৌদি আরবে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ ছিল। পরে ২০১৫ সাল থেকে নারী শ্রমিকদের পাঠানো শুরু হয়। যার বেশিরভাগই ছিল গৃহকর্মী হিসেবে। আসলে যখন থেকে নারী শ্রমিকরা যাওয়া শুরু করে তার পর থেকেই কিন্তু নির্যাতনের অনেক অভিযোগ আসতে থাকে। অনেক নারী বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে আসেন। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির থেকে জানা গেছে যে, গত পাঁচ বছরে ৫ শতাধিক নারী শ্রমিকের অপমৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এসব অপমৃত্যুর ঘটনার কোনটি আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। এবারই প্রথমবারের মতো কোন বাংলাদেশি হত্যার ঘটনায় রায় এলো। অভিবাসন বা নারী শ্রমিকদের নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা এসব ঘটনা প্রতিরোধে তারা সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং দুই দেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার কথা বলছেন। এখন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকে সৌদি শ্রমবাজারে নারী-কর্মী বন্ধের পক্ষে যেমন অনেকে আছে, আবার সুরক্ষা নিশ্চিত করে নারীদের পাঠানোর পক্ষেও মতামত দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সৌদিতে থাকা বাংলাদেশিদের কথা হল, নারী কর্মীদের নিরাপত্তার স্বার্থে দূতাবাসকে আরো তৎপর হতে হবে।