সারা দেশে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বিভাগকে অধিকতর সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় এ নির্দেশ দেয়। এদিকে নির্দেশনার পর কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। তাদের পক্ষ থেকে থানার প্রতিটি টহল টিমকে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।
এদিকে পুলিশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারা দেশে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে ৭টি পদক্ষেপের কথা তুলে ধরা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যবিবরণীতে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এতে কিশোর গ্যাং নিয়ে পুলিশ অধিদপ্তরের বিস্তারিত প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (প্রশাসন-১ অধিশাখা) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম মজুমদার।কিশোর গ্যাং প্রসঙ্গে সংসদীয় কমিটি সাংবাদিকদের জানিয়েছে, সম্প্রতি কিশোর গ্যাং বেড়েছে। শহর ও গ্রামের আনাচে-কানাচে এ ধরনের গ্যাং তৈরি হয়েছে।
অল্প বয়সেই তারা ভয়ঙ্কর সব অপরাধের সঙ্গে জড়াচ্ছে। এতে অপরাধ যেমন বাড়ছে, তেমনি সমাজের শান্তিও বিনষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে পুলিশের মাধ্যমে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এদিকে সংসদীয় কমিটিতে দেয়া প্রতিবেদনে পুলিশ জানিয়েছে, গত ৪/৫ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিশোরদের একটি অংশ খুন, ছিনতাই ও সাইবার ক্রাইমসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। এ সকল কিশোরের বয়স গড়ে ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। তারা ১০/১৫ জন মিলে বিভিন্ন গ্যাং তৈরি করে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, নিজের শক্তিমত্তা প্রদর্শন বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অপরাধের সকল ঘটনাতেই বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী কর্তৃক অপরাধী কিশোরদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদের কৃতকর্মের বিষয়ের জন্য কিশোর আদালতে সোপর্দ করা হচ্ছে। কিশোর আদালতে বিচার শেষে যাদের সাজা হচ্ছে বা যাদেরকে বিজ্ঞ আদালত ‘সংশোধন হওয়ার প্রয়োজন’- বলে মনে করেছেন তাদের আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন কিশোর অপরাধ সংশোধনাগারে পাঠানো হচ্ছে। কিশোর অপরাধী বিচারে পৃথক আইন, আদালত এবং সংশোধনাগার রয়েছে। এলাকাভিত্তিক কিশোর অপরাধীরা যাতে কোনো গ্যাং তৈরি করে অপরাধ করতে না পারে এবং এলাকার কোনো কুখ্যাত অপরাধী, মাদক ব্যবসায়ী বা স্বার্থান্বেষী কোনো গোষ্ঠী কিশোরদের প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে অপরাধী হিসেবে গড়ে তুলতে না পারে সে বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ সজাগ রয়েছে এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে পুলিশ জানিয়েছে, কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের জন্য গাজীপুরে টঙ্গী ও কোনাবাড়ীতে এবং যশোরে সংশোধন কেন্দ্র রয়েছে। এ সকল সংশোধন কেন্দ্রে কাউন্সিলিং, সাইকোলজিক্যাল থেরাপিসহ উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা যুগোপযোগী করা যেতে পারে। একজন কিশোর অপরাধী সংশোধন কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার পর যেন পুনরায় কোনো অপরাধ কর্মে না জড়ায় সেভাবে তাকে সক্ষম করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এতে আরও বলা হয়েছে, সংঘটিত অপরাধগুলোতে জড়িত কিশোর অপরাধীদের সম্পর্কে অনুসন্ধানে শিশু/কিশোরদেরকে অপরাধে জড়াতে বিভিন্ন কারণ প্রভাবিত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তন্মধ্যে পারিবারিক, সামাজিক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও মূল্যবোধের অভাব, বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার অপ্রতুলতা, অসুস্থ বিনোদন, পেশাদার অপরাধীদের কর্তৃক কিশোরদের মধ্যে হিরোইজম সৃষ্টির অপকৌশল, অভিভাবকদের উদাসীনতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবক কর্তৃক কিশোর সন্তানের হাতে সহজেই দামি মুঠোফোন, মোটরসাইকেল, টাকা তুলে দেয়া ইত্যাদি বিষয়াবলী জড়িত রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সমাজের শত্রু, মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীরা শিশু/কিশোরদেরকে মাদকের ফাঁদে ফেলে তাদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা প্রতিরোধে পাড়া, মহল্লায় তথা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ও স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সতর্ক ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে। থানার প্রতিটি টহল টিমকে কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে সারা দেশে বিভিন্ন বিট পুলিশের মাধ্যমে সমাবেশ করা হচ্ছে।
পুলিশ অধিদপ্তরের ৭ পদক্ষেপ এদিকে সারা দেশে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে পুলিশ অধিদপ্তর যেসব পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেছে সেগুলো হচ্ছে- প্রথমত: ছাত্র ও ঝরে পড়া সব কিশোর সন্তানের গতিবিধি সম্পর্কে পিতা-মাতা, অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজনদের বাড়তি পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধিসহ মাদক সেবন, অপরাধ ও জঙ্গিবাদের মতো ভয়ানক কাজে জড়ানো রোধে এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারিভাবে ব্যাপক সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত- যে সকল ছাত্ররা ৩ দিনের বেশি স্কুলে না আসে তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। তৃতীয়ত- কিশোর গ্যাং-এর সদস্য বা কিশোর অপরাধীরা যাতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না পায় এ বিষয়ে কেন্দ্র থেকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া যেতে পারে। চতুর্থত- এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে উক্ত সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। পঞ্চমত-জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলসমূহের কর্তৃপক্ষকে একটি কঠোর নির্দেশনা দেয়া সমীচীন। ষষ্ঠতম-বিভাগীয় প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসনের মাধ্যমের এর বিরুদ্ধে গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়ে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করে এ বিষয়টি মোকাবেলা করা সমীচীন। সপ্তমত-সামাজিক যোগাযোগসহ অনলাইন মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রম নিয়মিত মনিটরিং করা যেতে পারে। এ ছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের ক্ষতিকর কার্যক্রম সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় অডিও/ভিডিও/বিবৃতি প্রদান করা যেতে পারে।